হুজ্জাতুল ইসলাম মাওলানা হায়দার আলী সাহেব, মুবাল্লিগ ও পেশ ইমাম (উত্তর ২৪ পরগনা জেলার নারিকেল বেড়িয়া গ্রাম)।
প্রশ্ন: আসসালামু আলাইকুম, মাওলানা সাহেব। আমরা আজ এমন একটি প্রশ্ন নিয়ে কথা বলতে চাই, যেটি অনেকের মনেই আসে—এই (ইরান ও ইসরায়েল) চলমান যুদ্ধ ও রাজনৈতিক উত্তেজনার প্রেক্ষাপটে, সাধারণ মুসলিম এবং সাধারণ ইহুদি নাগরিকদের দৃষ্টিভঙ্গি আসলে কেমন?
মাওলানা হায়দার আলী: ওয়ালাইকুমুস সালাম ওয়া রাহমাতুল্লাহ। খুব গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন করেছেন, মজিদুল ইসলাম শাহ ভাই। বাস্তবতা হলো—রাজনৈতিক নেতৃত্ব যেভাবে দ্বন্দ্বকে উসকে দেয়, সাধারণ মানুষ সেই পথে হাঁটে না। সাধারণ মুসলমান এবং সাধারণ ইহুদি—দুই পক্ষেই একটা বড় অংশ আছে যারা শান্তি চায়, নিরাপত্তা চায়, পারস্পরিক সহাবস্থান চায়।
প্রশ্ন: তাহলে আপনি বলছেন, এই সংকট সাধারণ মানুষের সৃষ্টি নয়?
মাওলানা হায়দার আলী: একদমই নয়। সাধারণ মানুষ যুদ্ধ চায় না। আপনি যদি একজন সাধারণ ফিলিস্তিনি মুসলমান বা একজন সাধারণ ইসরায়েলি ইহুদির সঙ্গে কথা বলেন, দেখবেন—তারা পরিবার নিয়ে শান্তিতে থাকতে চায়, সন্তানদের নিরাপদ ভবিষ্যৎ দিতে চায়। কিন্তু শাসকগোষ্ঠী, উগ্র রাজনৈতিক দল ও চরমপন্থী চিন্তাধারা এই শান্তিকামী মানুষের কণ্ঠকে চাপা দেয়।
প্রশ্ন: মুসলিম দুনিয়ার সাধারণ জনগণ এই যুদ্ধ ও ইসরায়েল বিরোধিতা নিয়ে কীভাবে ভাবছে?
মাওলানা হায়দার আলী: মুসলিমদের মধ্যে ফিলিস্তিন ইস্যু এক আবেগী ও ধর্মীয় বিষয়। তারা এটিকে শুধু ভূখণ্ডের ইস্যু নয়, বরং একটি বিশ্বাস, একটি ঐতিহাসিক দায়িত্ব হিসেবে দেখে। তাই তাদের দৃষ্টিভঙ্গিতে স্পষ্টভাবে ইসরায়েলের আগ্রাসনের বিরুদ্ধে ঘৃণা আছে, কিন্তু একইসঙ্গে একজন সাধারণ ইহুদি মানুষকে শত্রু হিসেবে দেখার প্রবণতা নেই। ইসলামের শিক্ষা তো এটাই—অন্য ধর্মাবলম্বীর সঙ্গে ন্যায় ও সদ্ব্যবহার।
প্রশ্ন: আর ইহুদি নাগরিকদের দৃষ্টিভঙ্গি?
মাওলানা হায়দার আলী: বহু ইহুদি নাগরিক, বিশেষ করে পশ্চিমা দেশগুলোতে বসবাসকারী ইহুদিরা, ইসরায়েল সরকারের সব কর্মকাণ্ডকে সমর্থন করে না। নিউ ইয়র্ক, লন্ডন বা তেলআবিবেও আপনি হাজার হাজার ইহুদি দেখবেন যারা "Not in my name" বলে ফিলিস্তিনিদের ওপর হামলার প্রতিবাদ করে। এমনকি অতি-ধর্মভীরু ইহুদি গোষ্ঠীগুলো পর্যন্ত বলেছে, এই আগ্রাসন ধর্মবিরোধী।
প্রশ্ন: তাহলে এই দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে ঐক্য বা সহমর্মিতার কোনো ক্ষেত্র আছে?
মাওলানা হায়দার আলী: অবশ্যই আছে, এবং সেটিকে বিকশিত করা আমাদের কাজ। আমরা যদি ইসলামের প্রকৃত মূল্যবোধ অনুসরণ করি—যেখানে “লা ইকরাহা ফিদ্দিন” বলা হয়েছে, অর্থাৎ ধর্মে জোরজবরদস্তি নেই—তাহলে আমরা ইহুদি ভাইদের সঙ্গে মানবতার ভিত্তিতে সম্পর্ক গড়ে তুলতে পারি। একইভাবে ইহুদি ধর্মেও মানবতার শিক্ষা আছে। তাই সহমর্মিতা সম্ভব, যদি রাজনীতি তাতে বাঁধা না হয়।
প্রশ্ন: আপনার দৃষ্টিতে, কীভাবে এই সাধারণ মানুষের দৃষ্টিভঙ্গিকে সামনে আনা যায়?
মাওলানা হায়দার আলী: গণমাধ্যম, শিক্ষাব্যবস্থা ও আলেম সমাজের উচিত—সংঘাত নয়, শান্তির বার্তা ছড়ানো। উস্কানিমূলক বক্তব্য পরিহার করে, মানবিক মূল্যবোধ ও পারস্পরিক শ্রদ্ধার শিক্ষা দিয়ে একটি সেতুবন্ধন গড়ে তোলা সম্ভব। মিডিয়া যেভাবে শুধু সংঘাত তুলে ধরে, আমাদের উচিত ঠিক তার বিপরীত—সহানুভূতির চিত্র সামনে আনা।
প্রশ্ন: খুব ভারসাম্যপূর্ণ ও জ্ঞানগর্ভ বিশ্লেষণের জন্য আপনাকে আন্তরিক ধন্যবাদ, মাওলানা সাহেব।
মাওলানা হায়দার আলী: আপনাকেও ধন্যবাদ। আল্লাহ আমাদের সবাইকে সত্য, সহনশীলতা ও ইনসাফের পথে পরিচালিত করুন।
সাক্ষাৎকার গ্রহণ: মজিদুল ইসলাম শাহ
আপনার কমেন্ট